Thursday 4 October 2012

পর্দার এপারে

আচ্ছা প্রত্যেকের জীবনেই কি এমন কিছু ঘটনা বা অধ্যায় থাকে যা মনে পড়লেই বালিশে মুখ লুকোতে ইচ্ছে করে? এ নিশ্চয় শুধু আমার মাথার ব্যারাম নয়... বিশ্বাস করুন যদি উত্তরটা ‘না’ হয় তবে মন খুলে কিছু কথা বলতে পারি। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলে আমায় পাগল প্রমাণ করতে চান তাহলে আমিও মুখ ভেংচে বলবো- তাতে আমার বয়েই গেছে। এমন কী নিন্দুকে যদি আমাকে জটিল বা ঝগড়ুটে বলে আজ থেকে আমি আর পাত্তা দেবো না। আহ্‌, অটোবার এমনি এমনি খাচ্ছি না... আছে আছে কারণ আছে।

দোষের মধ্যে আমার একমাত্র দোষ হলো ছোট থেকেই আমি একটু মেলোড্রামা পছন্দ করি। আনন্দে, দুঃখে, অভিমানে আমার মতো হাপুস নয়নে কাঁদতে পারে, এমন জুড়ি মেলা ভার... না না একে দুর্বলতা ভাবার কোনো কারণ নেই, আমি তো একে নিজের আবিষ্কার করা একটা হাতিয়ার হিসেবে দেখি। আর মেলোড্রামার হাত ধরেই রূপোলি পর্দায় যেকোনো রোমান্টিক বা ইমোশনাল সিনে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যে চরম আনন্দ তা আমি আর অন্য কিছুতে পাইনি। জীবনের প্রথম চুমু মানে স্বপ্নে যেটা খেয়েছিলাম আর কি, ওই বাড়ির ছাদে জলের ট্যাঙ্কের পেছনে, তাও এক সিনেমার হিরোকে।
একটা বয়স অবধি বদ্ধমূল ধারণা ছিল একদিন না একদিন আমার স্বপ্নের নায়ক মারপিট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ছেঁড়া জামাকাপড়ে স্ক্রিন ফুঁড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন ওকে সুস্থ করতে কোন ফলের রস খাওয়ানো উচিত তা নিয়ে বাবার সাথে লম্বা-সিরিয়াস আলোচনা করতাম সে কথাও স্পষ্ট মনে আছে... কিন্তু যে বোকামির কথা ভেবে ভেবে এতদিন লজ্জায় মুখ লাল করেছি সেটা শুধু আমার মনগড়া ধারণা নয়... অনেক বিখ্যাত মানুষ-ও অমন ভেবে থাকেন। শুধু তাই নয়, সেই ভাবনার জালে আটকেও যান ঠিক আমার মতো। এই দেখুন Woody মহাশয় কি বলছেন

“ Purple Rose was a film that I just locked myself in a room. The truth of the matter is, I tried to write that… that the guy steps off the screen, and I wrote it and halfway through it didn't go anywhere and I put it aside. I didn't know what to do. I toyed around with other ideas …. ”
কি কিচ্ছু বোঝা গেল না তো! আরে আমি সদ্য দেখা “The Purple Rose of Cairo” কথা বলছিলাম। এককথায় যদি আমাকে সিনেমার বিষয়বস্তু জিজ্ঞাসা করা হয় তবে বলবো এটা একটা অদ্ভুত ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র সিসিলিয়া ঠিক আমার আপনার মতোই রোজকার জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব না মেলাতে পেরে দিনের শেষে আত্মসমর্পণ করে রূপোলি পর্দার সামনে। বেকার স্বামীর অত্যাচার, প্রায় হারাতে বসা ওয়েট্রেসের চাকরি... দিনের শেষে সব ভুলে থাকার রসদ ওই একটাই। আর মন ভোলাতে ভালো লেগে যাওয়া নায়কের ছবি ও একবার নয় বার বার দেখে... “The Purple Rose…” সিসিলিয়ার সেই সব ভালো লেগে যাওয়া ছবির তালিকায় নতুন এন্ট্রি। একজন ধনী নাট্যকারে ইজিপ্ট ভ্রমণ নিয়ে তৈরি এই ছবির অন্যতম চরিত্র টম ব্যাক্সটার, পেশায় টম আর্কিওলজিস্ট। Cairo-র ‘Purple Rose’ এর খোঁজে ওঁর ইজিপ্ট আসা। টমের প্রাণবন্ত মিষ্টি চরিত্র, ইজিপ্টের মরুভূমি, পেন্টহাউস, ডান্স ফ্লোরে চুমুর দৃশ্য সব কিছুই এত ‘পিকচার পারফেক্ট’ যে তার ঘোর পরদিন সকাল অবধি সিসিলিয়াকে তাড়া করে আর বাধ্য করে আবার-ও দিনের শেষে থিয়েটারে আসতে। এ যাবৎ সব ঠিকই চলছিল, গোল বাঁধল যেদিন স্বপ্নের নায়ক টমের দৃষ্টি পর্দার ওপার থেকে সিসিলিয়াকে দেখলো। শুধু দেখলো নয় কথা বলতে বলতে একদম পর্দা ফুঁড়ে (ঠিক আমি ছেলেবেলায় যেমন ভাবতাম) সিসিলিয়ার সামনে এসে হাজির হলো... আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই টম ওকে নিয়ে থিয়েটার থেকে পালিয়ে এক নির্জন পার্কে এসে হাজির। প্রায় দু’হাজার বার একই চরিত্রে একঘেয়ে অভিনয় করতে করতে ও ক্লান্ত... এবার ও চায় সিসিলিয়ার হাত ধরে বাস্তব জগত টাকে চিনতে। হ্যাঁ, প্রতিবার-ই পর্দার আড়াল থেকে সিসিলিয়ার দৃষ্টি টমকে আকৃষ্ট করেছে। একমাত্র সিসিলিয়ার ওপর ভরসা করেই ও নিখুঁত রঙ্গিন জগত ছাড়তে প্রস্তুত।
 এই ঘটনা সিনেমার বাকি চরিত্র গুলোকে ধন্ধে ফেলে দেয়। তারা চেষ্টা করেও ‘রিয়্যাল ওয়ার্ল্ডে’ আসতে পারছে না, আবার টমের অনুপস্থিতিতে ওই স্ক্রিনে সিনেমা-ও বন্ধ। ওদিকে অন্যান্য থিয়েটারেও টমের চরিত্র স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে পরিচালক শহরে এসে উপস্থিত হন। আর উঠতি কেরিয়ার সামলানোর দায়ে সঙ্গে আসেন গিল শেফার্ড, যিনি টম চরিত্রের অভিনেতা। টমের খোঁজ করতে গিয়ে খানিকটা দুম করেই সিসিলিয়া আর গিলের আলাপ। গিল এমন একজন অভিনেতা যাঁর অভিনয় দক্ষতা শুধু “Purple Rose”-এ নয়, আর-ও অনেক ছবিতে সিসিলিয়াকে মুগ্ধ করেছে। গিলের দক্ষতাতেই টমের চরিত্র এতখানি জীবন্ত... বাস্তবে সেই টমের স্রষ্টা। গিল আর সিসিলিয়ার চেনা জগতের পরিধি অনেক বেশি... ব্যাস আর কী? সিসিলিয়া আর গিলের বন্ধুত্ব জমে উঠতে বেশি সময় লাগলো না। সিসিলিয়ার সাথে গিল এতটাই সাবলীল যে ওকে নিয়ে হলিউড পাড়ি দেওয়ার কথাও মুহূর্তেই ভেবে ফেলতে পারে...

Purple rose এর বিশেষত্ব হলো Allen এখানে কোনো ঘটনাই কেন ঘটছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন নি। আসলে সিসিলিয়ার মতো স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে এমন যেকোনো মানুষ-ই বাস্তব জগতে কল্পনার অনধিকার প্রবেশকে চোখ বুজে মেনে নেয়, সময়ে সময়ে তাকে প্রশ্রয়ও দেয়। তাই বাস্তব আর কল্পনার এই সংমিশ্রণের ব্যাখ্যা দিতে যাওয়াটা এক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন... এদিকে টমের চরিত্র আপনার ভাবনাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। টম সাদা কালো পর্দা ছেড়ে রঙ্গিন বাস্তব জগতে এলেও সেখানে ও বড়ই বেমানান। সে রেস্তোরাঁয় না বুঝে সিনেমায় ব্যবহার করা নকল টাকা দেওয়াই হোক বা সিসিলিয়ার সাথে প্রথম চুমুর পরেই ‘fade out’ না হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা। যদিও সিসিলিয়ার কথায়- “It’s what I dreamed kissing would be like”। ওদের ভালবাসার সারল্য প্রতি মুহূর্তে আপনাকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে কিন্তু পাশাপাশি এর মেয়াদ কতখানি সে ভাবনাও আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবে। কাজেই বাস্তবের চেনা রাস্তায় হাঁটার আত্মবিশ্বাস নাকি নতুন জগতের কানাগলি খুঁজে পাওয়ার আনন্দ... সিসিলিয়া শেষ অবধি কোনটা বেছে নেবে?

এরপরের গল্প বলে দিলে সিনেমা দেখার মজাটাই নষ্ট হবে... বরং অন্য কথা বলি... গিল আর টম এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা Jeff Daniels। আর সিসিলিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছেন Mia Farrow। প্রত্যেকেই যে যার ভূমিকায় সাবলীল। আর Woody নিজস্ব ভঙ্গিতে সিনেমায় পর্যাপ্ত পরিমাণে হাসি-কান্না-রাগ মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। যে কয়েকটা কথা না বললে মনটা খুঁত খুঁত করবে-

      ১.  Purple rose, BAFTA Film Award এ সেরা ছবির পুরস্কার পায় আর সেরা চিত্রনাট্য বিভাগে Oscar nominated হয়।
      ২.  স্টেজের সামনে কাল্পনিক দেওয়ালের (Fourth wall) মাধ্যমে দর্শকের সাথে অভিনেতার ইন্টারঅ্যাকশনের গাল ভরা নাম হলো "breaking the fourth wall"।
      ৩.  আমার কথায় ভয় পাবেন না। বিশেষজ্ঞরা এই ছবিকে এককথায় কমেডি ছবির মর্যাদা দিয়েছেন... কাজেই প্রাণ খুলে আনন্দ পেতে চাইলে অবশ্যই Purple Rose দেখে নিতে পারেন।
      ৪.  সিসিলিয়া কি করবে জানি না, সিসিলিয়ার জায়গায় আমি থাকলে সাত পাঁচ না ভেবে টমের সাথে চলে যেতুম... ছেলেবেলার অভ্যেস তো সেকি কি আর এত সহজে বদলায়।

No comments:

Post a Comment