সিনেমা দেখেন নিশ্চয়ই- তা আগের বছর কি কি হিন্দি ছবি দেখেছেন মনে পড়ে? নাহ্, আমার মনে পড়তো না- যদি না সেদিন এক নাম করা পত্রিকায় দেখতাম –গত বছর আর এ বছরের শুরু তে মুক্তি পাওয়া কোন কোন ছবি ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেছে! নাম গুলো বলছি- ‘বডি গার্ড’, ‘রা-ওয়ান’, ‘ডন-২’ এবং ‘অগ্নিপথ’। কৌতূহল-বশে প্রায় সব সিনেমাই দেখে থাকি- তাই এগুলো-ও মিস্ হয়ে যায়নি। কিন্তু এই ছবিগুলোর বিপুল ব্যবসা করার কারণ কি? গত দু-তিন বছরের বলিউডের ঝোঁক
যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন প্রতি বছর-ই একটা করে ‘দাবাং’ বা ‘ওয়ানটেড’ ব্লক-বাস্টার হয়েছে। সিনেমাগুলো চলার কারণ শুধু ‘স্টার পাওয়ার’ হতে পারেনা- তাহলে তো সেই তারকা দের প্রতিটি সিনেমাই সমান পরিমাণ ব্যবসা করতো। তবে কি শুধু-ই মনোরঞ্জন? দেখা যাক!
বডি গার্ড সিনেমায় এক বলবান পুরুষের (অবশ্যই
ফিল্মের হিরো) ওপর দায়িত্ব বর্তায় এক প্রতিপত্তিশালী বাবার মেয়ের (হিরোইন!) রক্ষণাবেক্ষণের। প্রাথমিকভাবে তার বডিগার্ড কে নিয়ে আপত্তি থাকলেও কিছুদিনের
মধ্যেই হিন্দি সিনেমার চিরাচরিত ফর্মূলা অনুসরণ করে ‘বডিগার্ড’-এর প্রেমে পড়ে
যায়... বাকি গপ্পো? কি ভাবে এই দুটি মানুষের প্রেম পরিণতি পায় – ব্যস্, এইটুকুই।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগের হিন্দি সিনেমাগুলো মনে করলেও এতো দুর্বল চিত্রনাট্য খুঁজে
পাওয়া মনে হয় সত্যি-ই দুরূহ হবে। এই সস্তা প্রেম-কাহিনীতে মাঝে মধ্যেই কারণে
অকারণে রয়েছে বেশ কিছু গান, কিছু অ্যাকশন দৃশ্য আর তথাকথিত ক্লাইম্যাক্সে স্পেশাল এফেক্ট
ব্যবহারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা – যা দেখলে একটা অত্যন্ত খারাপ (বললেও কম বলা হয়) কমেডি
ছবি দেখছি বলে মনে হয়। সলমান খান অবশ্য তার ফ্যানেদের হতাশ করেননি, সবশেষে জামা
খুলে পেশীর প্রদর্শনী করে তবে ক্ষান্ত দিয়েছেন।
“রা-ওয়ান” – সিনেমার বাজেট প্রায় ১২৫
কোটি, সিনেমাটোগ্রাফি-র জন্যে বিদেশ থেকে ধার
করে আনা হয়- নিকোলা পিকোরিনি কে, যাঁর বাইরে অনেক অভিজ্ঞ লোকের সাথে কাজ করার
অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুধু তাই নয়- আর্ট ডিরেকশন, ভিসুয়াল এফেক্ট,
স্পেশাল এফেক্ট – প্রতিটি বিভাগের জন্যই নাইক
ডেন্ট, ম্যাট লোডার, নাইক মার্টিন-
এর সঙ্গে আরো অন্যান্য
ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি- নাইক ডেন্ট এ বছরের দুটো বিভাগে অস্কার জয়ী ছবি ‘The Iron Lady’-র আর্ট ডিরেক্টর। এদেশে সায়েন্স ফিকশন তৈরি হয়েছে হাতে গোনা
দু’চারটে। কাজেই বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ছবিটা ঘিরে আশাও ছিল অনেক। সিনেমার কাহিনী এক মধ্যবিত্ত পরিবারকে নিয়ে। ছেলের মন রক্ষার্থে বাবা যে ভিডিও গেমটি তৈরি
করেন তাতে ভিলেন (রা-ওয়ান) অনেক বেশি
ক্ষমতাশালী। সেই ভিলেন ঘটনাচক্রে পারিপার্শ্বিক জগতের সাথে কমিউনিকেট করতে শুরু
করে। তার ফলস্বরূপ এই পরিবারকে কি কি ভোগ করতে হয় আর তারা কীভাবে ‘রা-ওয়ান’ এর কাছ থেকে নিস্তার পান – সেটাই সিনেমার মূল বিষয় বস্তু। কি মনে
হচ্ছে- ভালো-ই তো! মন্দটা কোথায়? বলছি। রা-ওয়ান হোক বা বডিগার্ড- এখনকার হিন্দি
ছবির পরিচালকদের অদ্ভুত প্রবণতা হল কিছু ব্রেনলেস কমেডি-র
মাধ্যমে সিনেমা কে মনোগ্রাহী করে তোলা, তা চিত্রনাট্যের সাথে খাপ খাক বা না খাক। এই
যেমন রা-ওয়ানে কারণে অকারণে প্রায় বার পাঁচেক পু্রুষের যৌনাঙ্গে লাথি মারার দৃশ্য
ঠিক কেন দেখানো হয় কেউ জানে না। বাচ্চাদের স্কুলে একজন মোটা কৃষ্ণাঙ্গ
মহিলার উৎকট নাচ- চরম insensitivity ছাড়া আর কিছু নয়। এয়ারপোর্টের একটা দৃশ্যে gay নিরাপত্তারক্ষীকে ইম্প্রেস করে অন্যমনস্ক করার জন্য সিনেমার হিরোর বুকে দুল লাগিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি অত্যন্ত নিম্নমানের রুচির পরিচয়। অথবা হঠাৎ করে রজনীকান্ত কে নিয়ে এসে যে অ্যাকশন সিকোয়েন্স-টা তৈরি করা হয় তাতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা যতখানি কষ্টকর তার চেয়েও বেশি কষ্টকর ঘুমিয়ে পড়াটা। আর সবশেষে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এতো টাকা খরচা করে স্পেশাল/ভিসুয়াল এফেক্ট তৈরি করার পর (যদিও গোটা সিনেমায় মনে রাখার মতো কোন স্পেশাল এফেক্ট ছিল বলে মনে পড়ে না- লক্ষ্য করুন মনে রাখার মতো বলা হয়েছে, ভাল থাকতেই পারে- এই হলিউড বিশ্বাসী যুগে “মনে রাখার মতো”?) সেই দৃশ্য গুলোতে যে সংলাপ রয়েছে তা সহ্য করতে পারাটা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি এই ধরণের সিনেমা বানানোর জন্য এতোগুলো টাকা খরচা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা সিনেমার পরিচালকদের দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।
মহিলার উৎকট নাচ- চরম insensitivity ছাড়া আর কিছু নয়। এয়ারপোর্টের একটা দৃশ্যে gay নিরাপত্তারক্ষীকে ইম্প্রেস করে অন্যমনস্ক করার জন্য সিনেমার হিরোর বুকে দুল লাগিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি অত্যন্ত নিম্নমানের রুচির পরিচয়। অথবা হঠাৎ করে রজনীকান্ত কে নিয়ে এসে যে অ্যাকশন সিকোয়েন্স-টা তৈরি করা হয় তাতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা যতখানি কষ্টকর তার চেয়েও বেশি কষ্টকর ঘুমিয়ে পড়াটা। আর সবশেষে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এতো টাকা খরচা করে স্পেশাল/ভিসুয়াল এফেক্ট তৈরি করার পর (যদিও গোটা সিনেমায় মনে রাখার মতো কোন স্পেশাল এফেক্ট ছিল বলে মনে পড়ে না- লক্ষ্য করুন মনে রাখার মতো বলা হয়েছে, ভাল থাকতেই পারে- এই হলিউড বিশ্বাসী যুগে “মনে রাখার মতো”?) সেই দৃশ্য গুলোতে যে সংলাপ রয়েছে তা সহ্য করতে পারাটা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি এই ধরণের সিনেমা বানানোর জন্য এতোগুলো টাকা খরচা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা সিনেমার পরিচালকদের দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।
নাহ্, ডন-২ নিয়ে কচকচ করে আপনাদের
আর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেবোনা। তবে এটুকু বলতে পারি ‘দিল চাহতা হ্যায়’ আর ‘ডন-২’ যে
একই লোকের নির্দেশনায় তৈরি সেটা বিশ্বাস করাটা কঠিন। ‘ডন-২’ -বিভিন্ন বিদেশি ছবির
থেকে টুকরো টুকরো দৃশ্য ধার নিয়ে তৈরি হওয়া একটা খিচুড়ি, যা খেলে বদ হজম হতে
বাধ্য।
‘অগ্নিপথ’- নব্বইয়ের দশকে তৈরি
বলিউডের বিখ্যাত(!) ছবি... তারই রিমেক করলেন করণ জোহর। তিনি নির্দেশক নন শুধু প্রযোজক
জেনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। অল্প বয়সে বাবার অন্যায়- অযাচিত মৃত্যুর বদলা তাঁর
ছেলে বড় হয়ে কিভাবে নেবে সেটাই এই সিনেমার প্লট, যা প্রায় সকলের-ই জানা। কাজেই পুরনো
ছবি যখন নতুন করে দেখবো তাতে কিছু আধুনিকীকরণ আশা করাই যায়। কিন্তু সিনেমাটা দেখতে
বসে উপলব্ধি করলাম কিছু ভিসুয়াল এফেক্ট ছাড়া বাকি সমস্ত কিছুই নব্বইয়ের চেয়েও দু’দশক
পিছিয়ে রয়েছে। দেড় ঘণ্টায় যে ছবি তৈরি করা
সম্ভব তাকে টেনে হিঁচড়ে নির্মাতারা তিন ঘণ্টা ধরে দেখালেন। “চিকনি চামেলী...”
আইটেম নম্বর দেখাই যদি আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে আপনি অবশ্যই এই ছবি দেখতে
পারবেন। নচেৎ মেলোড্রামা করতে গিয়ে যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেওয়া হয়েছে আর
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে পরিমাণ চিৎকার করে সংলাপ আওড়িয়েছেন তা সিনেমার শুরু থেকেই
অসহনীয়। শেষ দৃশ্যে অসম্ভব পিটুনি খাওয়ার পর-ও নায়ক যেভাবে বিশাল আকৃতির ভিলেনকে
‘অগ্নিপথ’ আবৃত্তি করতে করতে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তা মনে রাখার মতো। আর ছোটখাটো ডিটেলিং
এর এতো গলতি তা আজ না হয় নাই বা বললাম। মনে হয় ঋত্বিক ঘটক এই ছবিটা আগে দেখে থাকলে
মেলোড্রামা কে ‘বার্থ রাইট’ বলতে ভয় পেতেন।
আর একটা আপাত তুচ্ছ দিক না বললেই নয়-এই প্রত্যেকটা সিনেমার নায়িকা চরিত্রগুলো এতোটাই গুরুত্বহীন যে তার ওপর সিনেমার সিকিভাগও
নির্ভর করেনা। অথচ এই চরিত্রগুলোতে নাকি অভিনয় করেছেন বলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রীরা। রোলের মেয়াদ
নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। ‘Zindagi Na Milegi Dobara’ ছবিতে লয়লা-র (ক্যাটরিনা
কাইফ) চরিত্রটা দীর্ঘমেয়াদি না হলেও সেটা অন্তত সিনেমার দর্শনকে ব্যক্ত করে। এই
মেন স্ট্রিম ছবি গুলোতে কবে যে নায়িকা, নায়কের প্রেমিকা ছাড়া অন্য কিছু হয়ে উঠতে
পারবে সেটা সত্যি-ই ভাববার।
গত বছর এই সমস্ত বিগ বাজেটের সিনেমার
ছাড়াও ‘That Girl in Yellow Boots’ আর ‘Dhobi Ghat’ রিলিজ
করেছিল। কোন রকম আড়ম্বরহীন ঝরঝরে চিত্রনাট্য আর অত্যন্ত স্মার্ট নির্দেশনার প্রায়
১০০ মিনিটের দুটো সিনেমা। এই ধরণের কিছু সিনেমা দেখলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় খুব শিগ্গিরি
আমাদের সিনেমাও আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু এই ছবিগুলো কবে এলো আর কবে
গেলো কেউ হদিস রাখে না। অবশ্যই ফিল্মের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দিকটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানে একটা ভাববার বিষয় আছে – নির্মাতা আর দর্শকের সম্পর্কটা কি
‘demand-supply’ এর? ‘ধোবি ঘাট’ চলবে না তাই বানাবো না –এরকম
পূর্ব নির্ধারিত কোন ধারণা কি কোন শিল্পের ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত? এটা কি অনেকটা
ছোটবেলা থেকে মেনে আসা ধর্মবিশ্বাসের মতো নয়? যা দেখে এসেছি যা মেনে এসেছি সেটাকেই
বহন করার চেষ্টা? মানে, এটা ‘বলিউড’- তাই এখানে ‘অগ্নিপথ’-ই চলবে আর হলিউডে তো ‘The Dark Knight’! এই গণ্ডিকে
পেরোনোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব কিন্তু নির্মাতাদের ওপরই বর্তায়। সিনেমা মানুষকে নতুন
করে ভাবতে শেখায়, চেনা জিনিস কে নতুন করে দেখতে শেখায়, সমাজ-বিবর্তনের ক্ষেত্রে
যার ভূমিকা গভীর। আর এই নতুন কিছু
দেখনোর দায়িত্বটা যদি আজকের নির্মাতারা নিতে না পারেন তবে এই স্থবির সমাজে ছবিগুলো
ব্যবসা হয়তো করবে তবে মানচিত্রের সীমারেখার বাইরে কোনদিন বেরোতে পারবে না।
No comments:
Post a Comment